শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০০৯

অম্বর ও আল্লাহ

অম্বর ও আল্লাহ
রায়হান খন্দকার
[এই লেখাটা পড়ে অনেকে হয়তো এটাকে গল্প ভাবতে পারেন। অথবা এটাকে ফ্রেডরিখ নীটশোর মত কোন দার্শনিক লেখা ভাবতে পারেন। কিন্তু এটা এর কোনটিই নয়। এটি শুধুই একটি লেখা । ]
দীহা। আমার বন্ধু। বলতে পারেন জীবনের একমাত্র বন্ধু। আমি কিন্তু খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশতে পারি। কিন্তু সত্যি বলতে কি কাউকেই আমার বন্ধু মনে হয়নি। কেবল এই একজনকেই জীবনের বন্ধু মনে হলো। সবচেয়ে কাছের। একেবারে চিন্তার মত কাছের। চিন্তাটা আসলে অদ্ভুত। মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারে কেবল চিন্তাই। দিহা আমাকে চিন্তা করার পদ্ধতিটা শিখিয়ে দিল। সেজন্যই যেন প্রতিটি চিন্তার শুরুতে দীহা আমার ভেতরে আবির্ভূত হয়। অথচ দীহার সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘ দিনের নয়।
দীহা খুবই সাধার। ওর সাধারণত্বের মধ্যে অসাধরণত্বই আমাকে চমকে দেয়। ওর গায়ে চটের তৈরী জামা। কিন্তু তা অপরিস্কার বা দুর্গন্ধময় নয়। আমি তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল আসলে আমার সামর্থ যে এর বেশি নেই। আবার আমি এর বেশি যোগ্যও নই। ওর চাহনী বা কথাগুলো একেবারেই নিস্পৃহ। যেমন নিস্পৃহ মানুষের সহমর্মিতাগুলো। দীহাই আমাকে উপলব্ধি করালো যে মানুষের সহমর্মীতার ধরণগুলো কত বেশি নিস্পৃহ হতে পারে।
ধীর পায়ে মরুভূমির ভেতর হেটে যায় দীহা। মরুভূমিটা হলো বালির সাগর। ঠিক যেমন আটলান্টি বা প্রশান্ত মহাসগরে থাকে রাশি রাশি হাইড্রোজেন আর অঙ্েেজনের অনু। তেমনি মরুভূমিতেও রাশ রাশি সিলিকা কনা। কিন্তু ওর মনে পড়ে মানুষের লোভ সিলিকার চেয়েও বেশি চাকচিক্যময় ও অগণিত। যেদিন সে দেখেছিল স্পেনীয় সেই নাবিক আর সিপাহীটিকে। যে কিনা মরুভূীমর সিলিকা কণার চেয়েও বেশি পরিমাণ লোভ জমা করে ইনকাদের সম্রাজ্যে প্রবেশ করেছিল। ইনকাদের থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ আতিথ্য গ্রহণ করেও ঐ লোভ ঠান্ডা হয়নি। ইনকাদের নারীদের ভোগ করেও সে তৃপ্ত হয়নি। তাদের থেকে জাহাজভর্তি স্বর্ণ নিয়েও সে শান্ত হয়নি। তার লোভকে মেটানোর জন্য ইনকাদের রাজাকে হত্যা করতে চাইল। হায়! দীহার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। যখন দেখে যে সেই সিপাহীটি তার লোভকে পূরণের জন্য এখনো মরিয়া। এখনো তার প্রেতাত্না ইনকাদের জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। তার উত্তরসূরীরাও তাকে অন্ধের মতো অনুসরণ করে। যদিবা তার ইনকাদের সম্রাট টুপাক আমারুকে পায়। যদিবা আবার তার সেই বিলকাবাম্বা শহরের উঁচু বেদিতে ইনকাদের শেষ সম্রাটকে টুকরো টুকরো করতে পারে।
নীল নদের তীর ধরে হাটতে হাটতে দীহা যেন খুব কাছ থেকেই স্বার্থপরতাকে দেখতে পেলো। আসলে সেদিন যেন ওর চোখ থেকেই আমি স্বার্থপরতাকে চিন্তা করতে শিখলাম। ও বলছিলো। দেখ এই যে পুরুষ রাজহাসটা । ও কিন্তু বাচ্চার কথা চিন্তাই করছে না। নিজের মত করে উদরপূতি করেই যাচ্ছ্ ।ে; কিন্তু মাদি রাজহাসটা নিজেও খাচ্ছে বাচ্চাদেরকেও খাওয়াচ্ছে।
কিন্তু দীহা ! ওরা কি ওদের সন্তানদের ভালবাসেনা?' আমি তড়িৎ প্রশ্ন ছুড়েছিলাম।
'বাসে। অবশ্যই বাসে। পৃথিবীতে এমন নেই যার মধ্যে ভালবাসা নেই। কিন্তু সব কিছুই ভালবাসা হবে যখন কিনা তা কেবল নিজেরই স্বার্থের আনুকূল্য পাবে। অসন্তুষ্টিতে কোন ত্যাগ নেই। অতৃপ্তিতে কোন দান নেই। স্বার্থহীন কোন ভালবাসাও নেই।' ও ধীরে ধীরে উত্তর দিয়ে গেল। যেন কোন উদার বৃক্ষ তার তীব্র ঘ্রাণওয়ালা ফুল থেকে পথিককে মাদকতা ঢেলে দিচ্ছে তার ফুলেল ঘা্রণের দ্বারা। উদারতার কথা বলতে গিয়ে সে বললো - আসলে পালনকর্তার মত উদার আর কেউ নেই। কিংবা তার মতো সুন্দর । বা ভয়ংকর ! অথবা তার স্নেহশীল কেউ নেই। আবার তার মতো নিষ্ঠুরও কেউ নেই।
এমনিভাবেই দীহা মরুভূমিতে হেটে চলে তার শীর্ণ আর টগবগে শরীর নিয়ে। যে শরীরের ভেতর আগুন। আর ঐ শরীর হলো আবদ্ধ এক খচ্চরের খাঁচা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন