রবিবার, ৭ মার্চ, ২০১০

রসুল (সাঃ) এর মক্কী ও মাদানী জীবন

রসুল (সাঃ) এর মক্কী ও মাদানী জীবন রসুলুল্লাহ (স:)এর নবুওয়াত লাভ নবুওয়াতঃ মুহাম্মদ (সঃ) এর বয়স যখন চলি্লশ বৎসর, তখন আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বজাহানের জন্য রহমত স্বরুপ এবং মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা করে পাঠালেন। ইতিপূর্বে পৃথিবীতে যত নবী রাসূল এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের নিকট থেকে আল্লাহ তায়ালা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে, তাঁরা নবী (সঃ) এর প্রতি ঈমান আনবেন, তাঁকে সমর্থন করবেন এবং তাঁর বিরোধীদের মোকাবেলায় সাহায্য করবেন। আর তাঁদের প্রতি যারা ঈমান আনবে ও সমর্থন জানাবে তাদেরকেও এই দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিবেন। রাসুল (সঃ)এর নবুওয়াত প্রাপ্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন এভাবে- আল্লাহ তায়ালা যখন রাসূল (সঃ) কে সম্মানিত করতে ও মানব জাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহিত করতে মনস্থ করলেন, তখন রাসূল (সঃ) নবুওয়াতের অংশ হিসেবে নিভর্ূল স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তখন তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সুর্যোদয়ের মত বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এই সময় আল্লাহ তাঁকে নির্জনে অবস্থান করার প্রতি আগ্রহী করেন। একাকী অবস্থান তার কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে। আব্দুল মালেক ইবনে উবাইদুল্লাহ বলেন : আল্লাহ তায়ালা যখন নবুওয়াতের সূচনা করলেন, তখন তিনি কোন প্রয়োজনে বাইরে বেরুলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে মক্কার পার্বত্য উপত্যকায় ও সমভূমিতে চলে যেতেন। তখন যে কোন পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই যেতেন ঐ পাথর বা গাছ বলে উঠত আস্সালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলুল্লাহ। তখন রাসুল (স:)পাশে তাকিয়ে গাছ পাথর ছাড়া কিছুই দেখতেন না। প্রকাশ্য দাওয়াত: গোপনে দাওয়াত তিন বছর চলার পর আল্লাহ রাসুল (স:)কে প্রকাশ্যে দাওয়াত দানের নির্দেশ দিলেন- "তোমাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা প্রকাশ করে দাও"। প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে আল্লাহর রাসুল (সঃ)কে প্রকাশ্যে দাওয়াত দানের নির্দেশ দিলেন _"তোমাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা প্রকাশ করে দাও।" প্রকাশ্য দাওয়াতের পদক্ষেপ হিসাবে রাসুল (সঃ) একদিন সাফা পর্বতের উপর দাঁড়িয়ে আরবের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ডাক দিলেন। আরবের তৎকালীন নেতৃত্বসহ সকল জনতা ছুটে এল। সমবেত লোকদের সামনে রাসুল (সঃ) দাওয়াত পেশ করলেন। দাওয়াতের দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসাবে রাসুল (সঃ) আব্দুল মোত্তালিবের পরিবারের লোকদের জন্য এক ভোজ সভার আয়োজন করলেন। ভোজের পর রাসুল (সঃ) সংক্ষেপে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। প্রকাশ্য দাওয়াতের তৃতীয় পদক্ষেপ হিসাবে রাসুল (সঃ) কাবার চত্তরে দাঁড়িয়ে আল্লাহর একাত্মবাদের ঘোষণা দিলেন। লোকদের মধ্য থেকে আওয়াজ উঠল -কাবার অবমাননা করা হয়েছে , হারাম শরিফের সম্মান হানি করা হয়েছে। চারদিক থেকে মুশরিকরা ছুটে আসল। মূূূলত এই ঘটনার পর মুশরিকদের সাথে রাসুল (সঃ) এর প্রকাশ্যে বিরোধ শুরু হল। মুশরিকরা রাসুল (সঃ) এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করলো। রাসুল (সঃ) এর বিরুদ্ধে মুশরিকরা যেসব অপপ্রচার করলো তা হলঃ (ক) এ ব্যক্তি একজন কবি। (খ) মুহাম্মদ (সঃ) একজন বাগ্মী । (গ) এ ব্যক্তির প্রচারিত ধর্ম -প্রাচীন বিশ্বাস কাহিনী। (ঘ) এ ব্যক্তিকে জীনে ধরেছে। (ঙ) মুহাম্মদ নির্বংশ। কূটতর্ক ঃ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, ঠাট্টা উপহাস, গালিগালাজ ও অশালীন উপাধি প্রদানের সাথে সাথে মোশরেকরা কূট তর্ক শুরু করে দিল। এসব তর্ক সমূহ ছিল একেবারেই অযৌক্তিক। যেমন - (ক) তুমি যদি নবী হয়ে থাক তাহলে এর স্বপক্ষে যুক্তি দেখাও। (খ) আকাশ থেকে সরাসরি এক দল ফেরেস্তা নামিয়ে আন। (ঘ) তুমি কিভাবে একজন নবী হলে, তুমি তো আমাদের মতই রক্ত মাংসে তৈরী একজন মানুষ? (ঙ) তোমার জন্য আকাশ থেকে ধন রত্ন তৈরী হয় না কেন ? (চ) তুমি আমাদের ভয় দেখিয়ে নেতা হতে চাইছো। তা না হলে কোথায় তোমার সেই আযাব তা নিয়ে আস না কেন ? (ছ) কেয়ামত সম্পর্কে তারা বলত, সেই দিন কবে ঘটবে বল? যুক্তি ঃ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, কুৎসা রটনা ও কূটতর্কের মাঝে কখন কখন কোরায়েশ নেতারা দুই -একটা যুক্তি প্রদর্শন করতো। যেমন- (ক) আমরা তো দেবতা গুলোকে কখন আল্লাহর চেয়ে বড় মনে করিনা। আমরা শুধু বলি, এই মূর্তি গুলো যেসব ব্যক্তির আত্না, তারা আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশ করতে পারে। (খ) মুহাম্মদের দাওয়াত মেনে নিলে আমাদের নেতৃত্ব ও প্রাধান্য থাকবে না। সন্ত্রাসী ও গুন্ডামী ঃ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, গালিগালাজ ও অপপ্রচারের সাথে সাথে কোরেশদের বিরোধিতা ক্রমশ গুন্ডামী, সস্ত্রাসী ও হিংস্রতায় রূপ নিতে থাকে। যেমন - (ক) রাসুল (সঃ) এর যাতায়াতের রাস্তায় নিয়মিত কাঁটা বিছিয়ে দিত। (খ) নামাজ পড়ার সময় ঠাট্টা ও হৈচৈ করতো। (গ) সিজদার সময় তাঁর পিঠের উপর পশুর নাড়ি ভূড়ি নিক্ষেপ করতো। কোরআন পড়ার সময় তাঁকে আহমক বলে গালি দিত। ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার অপচেষ্টা ঃ ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিরা যখন পানি মাথার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখে তখন বেসামাল হয়ে আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের উপর সব ধরনের অত্যাচার চালিয়ে যায়। তেমনি ভাবে মক্কাবাসীরা রাসল (সঃ)কে একেবারেই খতম করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এটা সম্ভব হয়নি। কারণ চাচা আবু তালেব রাসুল (সঃ) কে সব সময় আগলে রাখতেন। দুঃখের বছর ঃ নবু্যয়াতের দশম বছর রাসুল (সঃ) এর জীবনের দুঃখের বছর। এ বছরই রাসুল (সঃ) তাঁর অন্যতম ভরসা স্থল চাচা আবু তালেব এবং প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদিজা ইন্তেকাল করেন। এ দুজনকে হারিয়ে রাসুল (সঃ) একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন। শত্রুরা নতুন করে তাঁর উপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করলো। তায়েফে ইসলামের দাওয়াতঃ মক্কাবাসীরা যখন কোন ভাবেই রাসুল (সঃ) এর দাওয়াত কবুল করলো না তখন তিনি মনের মধ্যে এক বুক বেদনা নিয়ে দাওয়াতের নতুন মিশন নিয়ে তায়েফ গমন করলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি হতাশ হলেন। হিযরতঃ (মদীনায়) আল্লহর পক্ষ থেকে হিযরতের অনুমতি পেলে রাসূল (সঃ)সাহাবীদেরকে পর্যায়ক্রমে মদীনায় হিজরতের অনুমতি দিলেন। তিনি সাহাবিদেরকে বললেন "আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য একটি নিরাপদ আবাস ভূমি ও বিপুল সংখ্যক ভাই সংগ্রহ করে দিয়েছেন।" সাহাবীগণ হিজরত করে মদিনায় চলে যাওয়ার পর রাসুল (সঃ) হিজরতের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকলেন। এ সময় হযরত আলী (রাঃ), হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং মুষ্টিমেয় কয়েক জন ছাড়া আর কেউ মক্কায় ছিল না। এরপর আল্লাহর নির্দেশে একদিন রাসুল (সঃ) হযরত আবু বকর (রঃ)কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় হিজরতের পর তিনি আনসার এবং মুহাজিরদের সমন্বয়ে একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন। বদর যুদ্ধঃ রাসুল (সঃ) এর মদিনায় এসে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করাকে কোরায়েশরা সহজ ভাবে মেনে নেয় নি। তারা মদিনা আক্রমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। একদিন রাসুল (সঃ) জানতে পারলেন যে , আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কোরায়েশদের এক বিরাট কাফেলা সিরিয়ার দিক থেকে এগিয়ে আসছে। তিনি মুসলমানদেরকে তাদের দিকে পাঠিয়ে দিলন। বললেন "এটা কোরায়েশদের কাফেলা। এতে প্রচুর ধন সম্পদ রয়েছে। তোমরা ওদিকে এগিয়ে যাও। হয়ত আল্লাহ এসব সম্পদ তোমাদের হস্তগত করবেন।" হিযাযের কাছাকাছি এসে আবু সুফিয়ান ব্যাপারটি অাঁচ করতে পারলেন। তিনি একজন দূতকে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন এই সংবাদ নিয়ে যে, মুসলমানরা কাফেলা আক্রমণ করবে এবং তাদের সাহায্যে যেন একদল সেনা বাহিনী পাঠিয়ে দেয়। দূত মক্কায় পৌছে সংবাদ দেওয়ার পরই কোরায়েশদের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। প্রস্তুতি শেষ হলে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সবাই বদ্ধ পরিকর হল। রাসুল (সঃ) এই সংবাদ পাওয়ার পর সাহাবিদেরকে নিয়ে মদিনার বাইরে আসেন এবং বদর নামক স্থানে কোরায়েশদের মোকাবেলা করার জন্য তাঁবু গাড়েন। এ যুদ্ধে আল্লাহ মুসলমানদের এক অভাবনীয় বিজয় দান করেন। এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে আরবে মুসলমানরা এক নতুন শক্তি হিসাবে আত্ন প্রকাশ করে। ওহুদ যুদ্ধঃ বদর যুদ্ধ থেকে পরাজয়ের কলংক মাথায় নিয়ে কোরায়েশরা যখন মক্কায় পৌছল তখন তারা পরাজয়ের জ্বালায় পুড়ে মরছিল। এ যুদ্ধে কোরায়েশদের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ নিহত হয়েছিল। বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আবু সুফিয়ান রাসুল (সঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একদিন মদিনায় সংবাদ এল যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী মদিনার দিকে এগিয়ে আসছে। রাসুল (সঃ) এর ইচ্ছা ছিল মদিনার ভেতরে থেকে যুদ্ধ করা কিন্তু বেশীর ভাগ সাহাবীর পরামর্শ অনুযায়ী মদিনার বাইরে গিয়ে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত হয়। অতঃপর রাসুল (সঃ) এক হাজার সাহাবী নিয়ে রওনা হলেন। কিন্তু মাঝ পথে মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তিনশ লোক নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। অবশিষ্ট সাহাবিদের নিয়ে রাসুল (সঃ) ওহুদ পাহাড়ে তাঁবু স্থাপন করলেন। এ যুদ্ধে কতিপয় সাহাবীর ভুলের কারণে মুসলমানদের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। খন্দক যুদ্ধঃ পঞ্চম হিজরী সনের শাওয়াল মাসে খন্দক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের পটভূমি হল বনু নাজীর এবং বনু ওয়াইলের ইহুদিদের একটি সম্মিলিত প্রতিনিধি দল মক্কা গিয়ে কোরাইশদেরকে আহবান জানায় মদিনার উপর আক্রমণ করে রাসুল (সঃ) কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। এ কাজে তাদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। পরে ঐসব ইহুদি গতফান গোত্রের কাছে গেল এবং রাসুল (সঃ) এর সাথে যুদ্ধ করার আহবান জানাল। তারা আরো আশ্বাস দিল যে কোরায়েশরা তাদের সাথে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করবে। যথা সময়ে আবু সুফিয়ান তার বাহিনীসহ মদিনার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। গাতফান, বনু কাজারা এবং আসদা গোত্রও বের হল। রাসুল (সঃ) এই যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ মদিনার চার পাশে খন্দক বা পরীখা খনন করলেন। এ যুদ্ধে কোরায়েশ বাহিনী এবং তাদের মিত্ররা চরমভাবে পরাজিত হয়। যুদ্ধের ফলে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রটি আরবের এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠত হয় ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন